একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক এবং ক্ষুদ্রতম
একক হচ্ছে পরিবার, যা মানব সমাজেরও মূল ভিত্তি। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার
প্রাথমিক সংগঠন। মানব সৃষ্টির পর থেকেই তথা আদম ও হাওয়া (আ.) এর সৃষ্টি থেকেই
এ পরিবার প্রথা চলমান। আদম (আ.) এর সৃষ্টির পরই তার সঙ্গিনী হিসেবে হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি
করা হয়। জান্নাতে ফেরেশতাদের উপস্থিতিতেই তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। আল্লাহ তাদের বসবাসের
জন্য ব্যবস্থা করলেন জান্নাতে। তাদের মাঝে এ বৈবাহিক সম্পর্ক পৃথিবীতেও আল্লাহ অটুট রাখেন। তাদের ঔরসে আসে সন্তান। এভাবেই মহান আল্লাহ
আদম ও হাওয়া (আ.) তথা এক পুরুষ ও এক নারী থেকে বংশ বিস্তার শুরু করে আজকের এ পৃথিবীতে
অসংখ্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের
এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে ভাগ করেছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই
সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান,
যে বেশি খোদাভীরু।’
(সূরা আল-হুজুরাত : ১৩)।
পৃথিবীতে নবী-রাসুলরাই আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়
বান্দা ছিলেন। তারপর বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী হলেন তারা, যারা আল্লাহকে বেশি ভয় করেন। আমরা তেমনই এক খোদাভীরু
ব্যক্তির জীবন ও দায়িত্ব নিয়ে আজকে আলোচনা করব, যার পার্থিব আমল মহান
রাব্বুল ইজ্জতের কাছে এতটাই বেশি গ্রহণীয় ছিল যে, তার নামে পবিত্র কোরআনে
পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা অবতীর্ণ করে দিলেন। তিনি হলেন লোকমান হাকিম। যদিও আমাদের সমাজে
একটি সংশয় বিদ্যমান রয়েছে যে,
তিনি কি সাধারণ কোনো মানুষ ছিলেন নাকি নবী? এর একটিই সরল উত্তর যে, তিনি আমাদের মতোই সাধারণ
মানুষ ছিলেন; কিন্তু আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন অফুরন্ত প্রজ্ঞা। ফলে তিনি হলেন আল্লাহর
একজন প্রিয় বান্দা, একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ও একজন বিশিষ্ট মনীষী। আর নবীরা পেয়েছিলেন
প্রজ্ঞাসহ ওহির জ্ঞান। ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বেহের বর্ণনা অনুযায়ী, মহাত্মা লোকমান হজরত আইয়ুব (আ.) এর ভাগ্নে ছিলেন। তাফসিরে বায়যাবির বর্ণনা
মতে, তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন এবং দাউদ (আ.) এর সময়ও বেঁচে ছিলেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)
এর মতে, ‘তিনি আবিসিনীয় কৃতদাস ছিলেন, কাঠ চেরাইর কাজ করতেন।’
তিনি অত্যন্ত কৃষ্ণকায় ছিলেন।
পৃথিবীতে এমন তিনজন
কৃষ্ণকায় ব্যক্তি রয়েছেন যারা মানবকুলে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। তারা হলেন, ১. হজরত বেলাল (রা.), ২. হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব
(রা.) কর্তৃক মুক্ত গোলাম হজরত মাহজা (রা.)। বদরযুদ্ধে যে ১৪ জন সাহাবি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছিলেন
তিনি তাদেরই একজন। ৩. হজরত লোকমান (আ.)। সর্বোপরি তিনি নবী ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান
ব্যক্তিত্ব ও ফকিহ। ব্যক্তিগত আমল ও আদর্শ সন্তান গঠনে তার যে দায়িত্ব ছিল সেটি
রাব্বুল আজিমের কাছে এতটাই পছন্দনীয় ছিল যে, সন্তানকে দেওয়া তার
উপদেশমালা পুরোটিই পবিত্র কোরআনে সংযোজন করে দিয়েছেন। তিনি তাঁর স্বীয় পুত্রকে
উদ্দেশ করে যে উপদেশ প্রদান করেছিলেন তা তার নামে অবতীর্ণ পবিত্র কোরআনের ৩১তম সূরা
তথা সূরা লোকমানে যথাযথভাবে স্থান পেয়েছে।
প্রথম উপদেশ শিরক সম্পর্কে : আল্লাহর প্রতি
পূর্ণ বিশ্বাস ছাড়া কোনো মানুষ মুসলিম বা মোমিন হতে পারে না। আর পূর্ণ বিশ^াস স্থাপন করা মানেই হলো, শিরক থেকে ফিরে আসা। শিরক কারও অন্তরে বিন্দুমাত্র
থাকতে সে ঈমানদার হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। লোকমান হাকিমও তার স্বীয় পুত্রকে ঈমানের এ মৌলিক বিষয় সম্পর্কে
সর্বাগ্রে উপদেশ প্রদান করেন। শিরক সম্পর্কে অল্লাহ কোরআনে অনেক কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে
বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শিরক ব্যতীত অন্য সব গোনাহ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করবেন।’
(সূরা নিসা : ৪৮)। তাই এ ভয়াবহতা থেকে
রক্ষা পেতে স্বীয় পুত্রকে বলেন,
‘হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে
শিরক করা মহা অন্যায়।’ (সূরা লোকমান : ১৩)। মানুষকে উপদেশ দেওয়ার ব্যাপারে একটি বিষয় সর্বদা খেয়াল রাখতে
হবে যে, শ্রোতাকে যেন কোমল ও নম্র ভাষায় সম্বোধন করা হয়। কেননা শ্রোতার হৃদয়
বক্তার প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বক্তব্য ফলপ্রসূ হওয়ার আশা করা যায় না। এ কারণেই লোকমান হাকিমও
তার পুত্রকে ‘ইয়া বুনাইয়্যা’ অর্থাৎ ‘হে বৎস’
এমন আদরমাখা শব্দ দ্বারা পুত্রকে সম্বোধন
করলেন। তিনি ‘ইয়া ওয়ালাদ’
বা হে ছেলে এমনভাবে সম্বোধন করতে পারতেন; কিন্তু হিকমতের কারণেই তিনি তা করেননি।
দ্বিতীয় উপদেশ তাকওয়া সম্পর্কে : আল্লাহ সর্বস্থানে
বিরাজমান এবং তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করার নামই খোদাভীতি বা তাকওয়া। মানুষ যেখানেই অবস্থান
করুক আর যা কিছুই করুক কোনোটিই আল্লাহর অজানা নয়। যেখানে গাছের একটি
পাতাও তার অজ্ঞাতসারে পতিত হয় না,
প্রস্তর শিলার মধ্যে অবস্থানরত সামান্য পোকাকেও
তিনি জীবন ও রিজিকদান করে থাকেন,
সেখানে আশরাফুল মাখলুকাতের সম্পর্কে গাফেল
থাকবেন এ কী করে হয়? লোকমান হাকিম তার স্বীয় পুত্রের ভেতরে এ বিষয়টিকে যথাযথ স্থান
দেওয়ার জন্য নসিহত করে বলেন,
‘হে বৎস! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও
হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তরগর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপন
ভেদ জানেন এবং সবকিছুর খবর রাখেন।’ (সূরা লোকমান : ১৬)। পিতা লোকমান (আ.) নিজের জীবনেও এ তাকওয়ার প্রতি অবিচল ছিলেন
বলেই সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে তিনি মহান রবের কাছে এত বেশি প্রিয় হতে পেরেছিলেন।
তৃতীয় উপদেশ কর্মে পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে :
আবশ্যকীয় কাজ তো অনেক, তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নামাজ। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি
স্তম্ভের দ্বিতীয়টি হচ্ছে সালাত তথা নামাজ। স্বীয় সন্তানকে লোকমান হাকিম আকিদার পরামর্শের পরই নামাজ কায়েমের
ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেন। কেননা ‘নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।’
(সূরা আনকাবুত : ৪৫)। এবং মানুষকে পুণ্যবান হতে সাহায্য করে। বিশিষ্ট পণ্ডিত লোকমান
হাকিমও তার সন্তানের কর্মে পরিশুদ্ধতার জন্য যা বলেছেন পবিত্র কোরআনে তা সংরক্ষণ করা
হয়েছে। ‘হে বৎস! নামাজ কায়েম
কর।’ (সূরা লোকমান : ১৭)। আর হাদিস শরিফেও সন্তানকে
সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ করতে বলা হয়েছে আর দশ বছরে (নামাজ আদায় না করলে মৃদু)
প্রহার করতে বলা হয়েছে।
চতুর্থ উপদেশ চরিত্র গঠন সম্পর্কে : চরিত্র
মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। ইসলাম উত্তম চরিত্র গঠনের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান
করেছে।
ইসলামে উত্তম চরিত্র বলতে মানবীয় সত্তার সামগ্রিক
সুকুমারবৃত্তিকে বোঝানো হয়েছে;
যা প্রতিটি মানবসত্তা, পরিবার,
বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয়
অনুশাসনের মাধ্যমে লাভ করে থাকে।
জন্মগতভাবেই প্রতিটি মানব সন্তানের চরিত্রের
দুটি দিক থাকে। কুপ্রবৃত্তি ও সুপ্রবৃত্তি। শৈশব থেকেই প্রতিটি
শিশু যেন কুপ্রবৃত্তির দিকে ধাবিত না হয়ে সুপ্রবৃত্তির দিকে আকৃষ্ট হয় সেদিকে লক্ষ্য
রাখতে লোকমান হাকিম স্বীয় পুত্রকে উপদেশ ও দায়িত্বারোপ করেই বলেন, ‘এবং সৎকাজের আদেশ দাও।’
(সূরা লোকমান : ১৭)।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ উপদেশ অন্যায়ে বাধা ও সংযমী
হওয়া সম্পর্কে : সৎকাজের আদেশ করা সহজ হলেও অসৎকাজে বাধা প্রধান করা একটি সাহসিকতাপূর্ণ
কাজ। এ কাজে এগিয়ে এলে নানা রকম বাধা, প্রতিরোধ আসবেই। এছাড়া জীবন পরিক্রমায় বহুবিধ বিপদ আমাদের প্রতিনিয়ত তার শুভ্র
চাদরে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমরা হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাই। চিন্তার প্রস্তর শিলা
বহন করি শিরে। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ আমাদের ধৈর্যের পরামর্শ
দিয়েছেন। আসলে প্রতিবাদ করতে যে শক্তির প্রয়োজন হয়, ধৈর্য ধারণ করতে তার কয়েকগুণ বেশি শক্তি লাগে। এ পরামর্শ আমরা অগ্রাহ্য
করে বরং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠি। অথচ আল্লাহর প্রিয় বান্দা লোকমান হাকিম তার পুত্রকে বলেছিলেন, ‘আর মন্দকাজে বাধা দাও এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এটি সাহসিকতার
কাজ।’ (সূরা লোকমান : ১৭)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ
তায়ালা ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে প্রায় ৬৯টি স্থানে ৬৯ ভাবে আলোচনার অবতারণা করেছেন। ব্যবহারের আধিক্যই
এর গুরুত্ব প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট।
সপ্তম উপদেশ সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে :
এরশাদ হয়েছে, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না।’
(সূরা লোকমান : ১৮)। আয়াতে অবজ্ঞা করার
যে আরবি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো ‘লা তুছায়্যির।’
এ শব্দের মূল ধাতুর অর্থ হলো, উটের এক ধরনের ব্যাধি, যার ফলে এর ঘাড় বেঁকে
যায়। যেমন মানুষের খিঁচুনি নামক প্রসিদ্ধ ব্যাধি হয়ে থাকে। ফলে মুখমণ্ডল বাঁকা
হয়ে যায়। সুতরাং শব্দের মর্মার্থ এই যে, লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথোপকথনের সময় মুখ ফিরিয়ে রেখো না। এটি তাদের প্রতি উপেক্ষা
ও অহংকারের নিদর্শন আর ভদ্রোচিত স্বভাব ও আচরণের পরিপন্থি।
অষ্টম উপদেশ নম্রভাবে পদচারণ করা সম্পর্কে
: ‘এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো
দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা লোকমান : ১৮)। আয়াতে গর্বভরে শব্দের আরবি ‘মারহা’ শব্দ ব্যবহার করে দাম্ভিকতা ও ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বিচরণ করাকে বোঝানো
হয়েছে। আল্লাহ ভূমিকে যাবতীয় বস্তু থেকে নত করে সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদের সৃষ্টিও
এই মাটি থেকে। যেহেতু এই মাটির ওপর দিয়ে আমরা চলি তাই নিজের নিগূঢ় তত্ত্ব বোঝার
বা অনুধাবন করণার্থেই লোকমান হাকিম তার স্বীয় পুত্রকে নম্রভাবে ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করার
নির্দেশ দিয়েছেন। আর দম্ভভরে পদচারণ করলে সমাজে গরিব-ধনীর মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়
এবং সামাজিক বন্ধনের মধ্যে বিরাট ফাটল সৃষ্টি করে।
নবম উপদেশ হাঁটার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তিতা অবলম্বন
করা সম্পর্কে : আগের আয়াতে দম্ভভরে হাঁটতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু লোকমান (আ.)
পরবর্তী আলোচনা দ্বারা হাঁটার ক্ষেত্রে নিজ গতিতে মধ্যবর্তিতা অবলম্বনের বিষয়টি স্পষ্ট
করেছেন। দৌড়-ঝাঁপসহ চলতে বারণ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে আছে, দ্রুতগতিতে চলা মোমিনের জন্য সৌন্দর্য ও মর্যাদাহানিকর। এভাবে চলার ফলে দুর্ঘটনায়
পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার অত্যধিক মন্থর গতিও সমীচীন নয়। কারণ, সেটি অহংকারী ব্যক্তি তার নিজেকে জানান দেওয়ার একটি পদ্ধতি কিংবা
তাদের অভ্যাস। সুতরাং চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাই যথার্থ হবে। লোকমান হাকিম বলেন, ‘এবং পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর।’
(সূরা লোকমান : ১৯)।
দশম উপদেশ কথা বলার আদব সম্পর্কে : কারও সঙ্গে
মতবিনিময় করলে কিংবা কথা বললে নিজের কণ্ঠস্বরকে নিচু রাখতে হবে। যেন আমাদের কথার কটু
আওয়াজ অন্যের জন্য পীড়াদায়ক না হয়। অর্থৎ স্বর প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চ না করা এবং হট্টগোল না করা। লোকমান (আ.) তার সন্তানকে
এ উপদেশ দিয়ে এর খারাপ দিকটিও উল্লেখ করে বললেন, ‘এবং কণ্ঠস্বর নিচু
কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’
(সূরা লোকমান : ১৯)। সুতরাং কথা বলার সময়
আমরা যদি আমাদের জিহ্বা নামক অসি নিয়ন্ত্রণে রাখি তবেই সমাজের ৯৫ শতাংশ বিশৃঙ্খলা হ্রাস
পাবে। একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। তারিখে তাবারিতে আছে, একদা লোকমান হাকিমের মনিব জানতে পারলেন যে, লোকমান একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। তার এ প্রজ্ঞা পরীক্ষা
করার জন্য একটি বকরি জবেহ করে তন্মধ্য থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দুটি অঙ্গ কেটে আনতে বললেন। লোকমান বকরি জবেহ করে
জিহ্বা আর কলবটি কেটে নিয়ে এলেন। মনিব আবার অন্য একটি বকরি জবেহ করে তার নিকৃষ্ট দুটি অঙ্গ কেটে
আনতে বললেন। লোকমান হাকিম বকরি জবেহ করে আবারও জিহ্বা আর কলবটি কেটে নিয়ে
এলেন। মনিব জিজ্ঞেস করলেন, উৎকৃষ্ট আর নিকৃষ্ট
দুটি ক্ষেত্রেই জিহ্বা আর কলব কেটে আনলে এর রহস্য কী? লোকমান হাকিম জবাবে বললেন, জিহ্বা আর কলব যদি
ভালো হয় তবে এর চেয়ে উত্তম আর কোনো জিনিস হতে পারে না। আর যদি এ দুটি খারাপ
হয় তবে এর চেয়ে আর খারাপ কোনো অঙ্গ হয় না। এরপর মনিব তার প্রজ্ঞায় অবিভূত হয়ে তাকে তার হিকমান দিয়ে রবের
সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য,
রবের ধর্ম প্রচার করার জন্য আজাদ তথা মুক্ত
করে দিলেন। সুতরাং জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা একটি উত্তম জিহাদ।
অতএব একজন পিতা হিসেবে সন্তানকে ইহকাল ও পরকালীন
সুখ-শান্তি নিশ্চিতকরণে লোকমান (আ.) এর চেয়ে অধিক মূল্যবান উপদেশ আর কী হতে পারে! আমরা
আমাদের সমাজের প্রতিটি পরিবার,
প্রত্যেক বাবা-মা, লোকমান হাকিমের মাত্র এ দশটি উপদেশ যদি তার সন্তানকে অভ্যস্ত
করাতে পারি এবং নিজেদের জীবনেও তা পূর্ণভাবে পালন করতে পারি তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়
যে, এ সমাজ হবে শান্তির সমাজ। যেখানে থাকবে না কোনো
অন্যায়, হত্যা,
লুণ্ঠন। এ রাজ্য হবে সুখের
রাজ্য। যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্মের ওপর অবিচল থাকবে। এ রাষ্ট্র হবে গরিব-ধনীর
এক মহা মিলনমেলা, যেথায় কেউ আত্মাভিমানীদের ধারা অনুসরণ করে অহংকার করে বিচরণ
করবে না। ভ্রাতৃত্বময় একটি ভূখণ্ড হিসেবে আমরা হব জ¦লন্ত শিখা। সূরা লোকমানের পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের দেশ, সমাজ ও আমাদের নিজেদের জীবন হোক আলোকময়, সুন্দর ও নির্মল এটিই প্রত্যাশা।
0 Comments