চলে গেলেন বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সংস্থা আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল
কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান,
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) সিনিয়র
সহসভাপতি দেশের অন্যতম সেরা ইসলামি বিদ্যাপীঠ মালিবাগ জামিয়ার মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস
আল্লামা আশরাফ আলী। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও ছয় ছেলে রেখে যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৯
বছর। আল্লামা আশরাফ আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট
অ্যাডভোকেট আবদুল হামি দ,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী
আলহাজ অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ।
ব্যক্তিগতভাবে তার ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার
হয়নি; কিন্তু এ-ও কম কী যে, তাকে দেখেছি। বহুবার এখানে-ওখানে
নানা উপলক্ষে তার কাছে যাওয়ার,
পাশে বসার, এমনকি দোয়া চাওয়ার
সৌভাগ্য হয়েছে। নুরানি অবয়ব,
আর হাসিমুখ দেখে মুগ্ধ হতে পেরেছি। আত্মবিস্মৃতি, আত্মবিকৃতি আর আত্মা বিক্রির এ যুগে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন
বাকিয়াতুস সালাফ বা পুণ্যবান পূর্বসূরিদের অবশিষ্টজন। এমন সালাফ পাওয়াও যে
জমিনবাসীর কত বড় কপাল, তা তো ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে উম্মাহর সামনে।
এখন তো সবাই প্রতিযোগিতা করছে শক্তিমানদের
তোষণ আর ক্ষমতাবানদের কাছে সুযোগ সন্ধানে। জাতির নিঃস্বার্থ কল্যাণভাবনা আর আল্লাহর নির্ভেজাল তাকওয়ার
শক্তিতে সুবিধাকে লাথি মারার লোক কই? দুর্জয়কে জয়ের সৈনিক
কই? দুর্জনকে সুজন ও স্বজন বানানোর প্রত্যয় কই? এমন রাতের আবেদ আর দিনের অশ্বারোহীদের তালিকা ক্রমে ছোট হয়ে
আসছে। নিভুনিভু এ প্রদীপগুলোরই একজন ছিলেন তিনি।
ওস্তাজে মুহতারাম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল
হক (রহ.) চলে যাওয়ার পর তিনিই ছিলেন হাদিসের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বোখারির অন্যতম
প্রধান মশালবাহী। এর আগে যখন সাহসী ও মুখলিস নেতৃত্বের শূন্যতায় মনে পড়ত জাতীয়
মসজিদের খতিব উবাইদুল হক (রহ.) কে,
তখনও হাহাকার কমে যেত তাকে দেখলে। সৌন্দর্যের দীপ্তি
আর ব্যক্তিত্বের বিভায় তিনি যে ছিলেন তার মতোই। তারপর মুরুব্বি সংকটে
ভোগা জাতি যখন সর্বজনাব আল্লামা শাহ আহমাদ শফীর পর তাকেই প্রধান মুরুব্বি ধরে নিয়ে
অগ্রসরমান, তখন তিনিই চলে গেলেন তাকে রেখে। গত বছর এই আসগর আলী
হসপিটালে তিনিও ভর্তি হয়েছিলেন আরও মুমূর্ষু অবস্থায়। কিন্তু তিনি ফিরলেও
অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরলেন না আল্লামা আশরাফ আলী (রহ.)। রব্বানিয়ানা নেতৃত্বের
শূন্যতা আরও দীর্ঘ করে তিনিও চলে গেলেন শুরু আছে শেষ নেই’র জগতে।
ইংরেজি বছরের শেষ দিনে আমার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু আমার আনন্দের
এ দিনে প্রথম আঘাত পেয়েছিলাম সেই তারুণ্যে যখন প্রিয়তম স্বপ্নপুরুষ আল্লামা আবুল হাসান
আলী নদভী (রহ.) এ দিন মৃত্যুবরণ করেন। শায়খের মৃত্যুতে এ দিন যোগ হলো আরেক আঘাত। জানি না ভবিষ্যতে এ
দিন আরও কত আঘাত নিয়ে ফিরে আসবে। (আল্লাহ উত্তম ফয়সালাকারী)। ৩১ ডিসেম্বর মধ্য রাতে
মৃত্যুর পর সেদিন বাদ জোহর নিজ বাড়িতে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে পিতার পাশেই
তাকে দাফন করা হয়। তার জানাজা নামাজে ইমামতি করেন হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমাদ
শফী। জানাজায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রীসহ সারা দেশ থেকে অসংখ্য আলেম-ওলামা
ও গুণিজন অংশগ্রহণ করেন।
মরহুমের জন্ম ১৯৪০ সালে। কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত
সদর উপজেলার ইসলামপুর/পল্টারপাড় গ্রামে। বাবা মাওলানা মফীজুদ্দীন (রহ.) ও মা কদরুন্নেসা বেগম। বাল্যকালে তার পড়ালেখার
সূচনা জন্মভিটার পাশের গ্রামের যশপুর মাদ্রাসায়। পরে কুমিল্লা কাসেমুল
উলুম মাদ্রাসা ও ঢাকার বড়কাটরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। সবশেষে পাকিস্তানের
জামিয়া বিন্নুরিয়া নিউটাউন মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপন করেন।
পড়াশোনা শেষে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া
এমদাদিয়ায় অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার বড়কাটরা, ফরিদাবাদ ও কুমিল্লার
কাসেমুল উলুম মাদ্রাসায় দরস ও শিক্ষা বিতরণের সেবা আঞ্জাম দেন। শেষ বয়সে তিনি ঢাকার
জামিয়া রাহমানিয়া, জামিয়া শারঈয়্যাহ মালিবাগসহ বহু মাদ্রাসায় বোখারির দরস দিতেন। জামিয়া শারঈয়্যাহ মালিবাগের
প্রিন্সিপালের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বহু দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
গড়ে তোলেন। নিজ গ্রামেও আল্লামা আশরাফ আলী মাদ্রাসায়ে ইমদাদিয়া নামে একটি
দ্বীনি বিদ্যাপীঠ গড়ে তোলেন।
তালিম তথা ইসলামি জ্ঞান বিতরণ, তাজকিয়া তথা মানুষের আত্মশুদ্ধি ছাড়াও তিনি আজীবন ইসলামিধারার
কল্যাণীয় রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। নিজ জেলা কুমিল্লা থেকে তিনি নির্বাচনও করেছিলেন। এসব ছাড়াও উল্লেখ করার
মতো আরও অনেক দিক আছে তার। কিন্তু যে দিকটি উল্লেখ করে লেখা শেষ করব, সেটি এ যুগে সবচেয়ে বেশি দরকারি অথচ সবচেয়ে বিরল।
এ মৃত্যুশয্যাতেই আসগর আলী হসপিটালে ক’দিন আগে তাকে দেখতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
কামাল। তিনি ভক্তি গদগদ না হয়ে বা নমঃ নমঃ না করে একজন সত্যিকার রব্বানি
আলেমের ভূমিকা দেখান। খাদেমকে বলেন, মন্ত্রীকে মেহমানদারি
করতে। তারপর পরিষ্কার তাকে বলে দেন, আলেমদের কাজ আমিরদের
পথ দেখানো। হক-বাতিল চেনানো, আর দায়িত্ব মনে করিয়ে
দেওয়া। আমি হয়তো থাকব না, এ বিদায়বেলায় আবার
মনে করিয়ে দিয়ে যাচ্ছি,
মিথ্যানবী দাবিদার কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে
কাফের ঘোষণা করা আপনাদের দায়িত্ব।
সেদিন শায়খের এ ভূমিকা আর কথার ভিডিও দেখে
চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। একইসঙ্গে আনন্দ-বেদনার অশ্রু এসেছিল। তাকে হারানোর বেদনা, আর একজন ব্যক্তিত্ববান চেতনাসম্পন্ন মুত্তাকি আলেমের ভূমিকা
দেখার আনন্দ।
তাকে যখনই দেখেছি, তার জবানে আল্লাহর জিকির ছিল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে
মুচকি হাসি যেন লেগেই থাকত। ছোটদের প্রতি তার স্নেহ-আশকারার মতো এ বুড়ো বয়সে বড়দের প্রতি
তার শ্রদ্ধা ছিল দেখার মতো। উম্মাহর কল্যাণচিন্তায় বিভোর ছিলেন বলেই অশীতিপর পর বয়সেও ছুটে
যেতেন এত জায়গায়। ছোট-বড় কত নানা কল্যাণমূলক প্রোগ্রামে তিনি ছুটে বেরিয়েছেন আমৃত্যু। এ অকৃতজ্ঞ আর গুণীদের
অবমূল্যায়নকারী জাতি তাকে দীর্ঘদিন মিস করবে। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা
করুন। আর তাকে স্থান দিন ফেরদাউসে মাহবুবদের মিলনমেলায়।
0 Comments