সারা বিশ্বে মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৪৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। মৃতের সংখ্যা ১৪ হাজার ৯০০-এরও বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতালিতে যেমন ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তেমনি হংকং, ম্যাকাও, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় দেখিয়েছে দারুণ সাফল্যও। এমনকি উৎপত্তিস্থল চীনই এখন করোনা নিয়ন্ত্রণের রোল মডেল। চীনে উৎপত্তির পর ৮১ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ২০০-এরও বেশি। কিন্তু সেই চীনেই এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। নতুন করে আক্রান্ত নেই বললেই চলে। বিশ্বজুড়ে করোনা মোকাবিলায় সফল দেশ ও শহরের গল্প নিয়েই এ আয়োজন।
উৎপত্তিস্থলই হয়ে উঠল নিয়ন্ত্রণের রোল মডেল
চীন
করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনে। প্রাণঘাতী ভাইরাসটির
আক্রমণে বিশ্বের জনবহুল দেশটি রীতিমতো কেঁপে ওঠে। বর্তমানে কভিড-১৯ নামের
এই রোগ বিশ্বের ১৬২টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গোটা বিশ্বে এ পর্যন্ত
অন্তত এক লাখ ৮৪ হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায়
৮০ হাজার মানুষ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া এই রোগে আক্রান্ত
হয়ে মারা গেছেন অন্তত ৭ হাজার মানুষ। যার অর্ধেকই চীনের নাগরিক। এত লোক হারিয়েও চীন
থমকে যায়নি। প্রায় আড়াই মাস লড়াই শেষে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম
হয়। তাই বিশ্বের কাছে চীন এখন ‘করোনা মোকাবিলায় মডেল’।
করোনা মোকাবিলায় চীনকে এখন সফল বলা চলে। কিন্তু কীভাবে এই সফলতা
এলো চীনের? এখন পর্যন্ত সফলভাবে করোনার কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। তবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায়
চীন কিউবার ওষুধ প্রযুক্তি ইন্টারফেরন আলফা টু-বি ব্যবহার করছে। ইন্টারফেরন মূলত প্রতিরক্ষামূলক
প্রোটিন। যদি কোনো দেহকোষ ভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তাহলে এটি নিঃসৃত হয়। বহিরাগত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক,
বিষ ও অন্য কোনো বস্তু ইত্যাদির আক্রমণ থেকে
রক্ষা করার জন্য প্রতিটি দেহে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে, এটি দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম। ইন্টারফেরন হলো প্রোটিন
জাতীয় রাসায়নিক প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র, যা দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্রের
অন্তর্গত। ভাইরাস আক্রমণের পর যখন ইন্টারফেরন নিঃসৃত হয় তখন তা আক্রমণকারী
ভাইরাসের প্রোটিন সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে ভাইরাসটি আর সংখ্যা
বৃদ্ধি করতে পারে না। তাই সে পরবর্তী কোষগুলোকে আর আক্রমণ করতে পারে না। কাজেই সংক্রমিত কোষের
চারপাশের কোষগুলো ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। আর এরা ভাইরাস-প্রতিরোধে
সক্ষম হয়ে ওঠে। কাজেই ইন্টারফেরনের কাজ হলো আক্রমণকারী ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি
বন্ধ করে দেওয়া এবং সুস্থ কোষগুলোকে ভাইরাস প্রতিরোধক্ষম করে তোলা ও ভাইরাসের আক্রমণ
থেকে রক্ষা করা। এর ব্যবহারেই চীন চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়াও মহামারী এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনতে
নানামুখী পদক্ষেপ নেয় চীন। করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই উহান শহর লকডাউন
করে দেয়। আক্রান্ত বাড়তে শুরু করলে হুবেই প্রদেশও লকডাউন করা হয়। খাদ্য ও ওষুধ ছাড়া
সব দোকান, শপিংমল সবই ছিল বন্ধ। গণপরিবহন,
স্কুল-কলেজও বন্ধ রাখা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে
কুরিয়ারের মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়।
এরপর ঘরে ঘরে গিয়ে নাগরিকদের পরীক্ষা করেছেন
দেশটির চিকিৎসকরা। করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হলেই তাকে আইসোলেশনে পাঠিয়েছেন। সেখানে নিবিড় পরিচর্যায়
রেখে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে আক্রান্তদের। চিকিৎসকদের একাগ্র
প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সফল তারা। করোনা প্রতিরোধে চীনই এখন বিশ্বের কাছে ভরসা। ইতিমধ্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম, পরামর্শ চেয়ে চীনের দ্বারস্থ অনেক করোনা আক্রান্ত দেশ। চীনও সাহায্যের হাত
প্রসারিত করছে স্বতঃফূর্তভাবে। মেডিকেল সরঞ্জামের পাশাপাশি করোনা বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে সহায়তা করছে
চীন। গত এক সপ্তাহে ইতালি, ফিলিপাইন, পাকিস্তান,
কম্বোডিয়া, ফ্রান্স, স্পেন ও ভ্যাটিক্যান সিটিতে কয়েক কোটি সার্জিক্যাল মাস্ক, টেস্ট কিট,
ভেন্টিলেটর পাঠিয়েছে চীন। এমনকি ইরাক ও ইরানে
করোনা বিশেষজ্ঞ টিম পাঠিয়েছে তারা। দেশটির অর্থনীতি বিপর্যয়ের মধ্যেও শ্রীলঙ্কাকে ৫০ কোটি ডলার
আর্থিক সহায়তা দিয়েছে করোনা মোকাবিলার জন্য। এ ছাড়াও করোনা আক্রান্ত ও ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর দিকেও সাহায্যের
হাত প্রসারিত করেছে চীন।
গণপরীক্ষায় মিলেছে সাফল্য
ভো
চীনে উৎপত্তি হলেও ক্ষয়ক্ষতি আর মৃত্যুর সংখ্যায়
চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ইতালি। দেশটিতে দিন দিন বেড়েই চলেছে লাশের সারি। বাড়ছে সংক্রমিত মানুষের
সংখ্যাও। কিন্তু এই সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে দেশটির ছোট্ট শহর ভো তৈরি করেছে
অভুত নজির। শহরটিতে এখন সংক্রমণের সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে।
ইতালির ভেনেতো অঞ্চলের শহর ভো। বিখ্যাত ভেনিস নগরী
থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৩০০। ইতালির একেবারে মাঝখানে
পড়েছে শহরটি। গত ফেব্রুয়ারিতে ইতালির অন্যান্য এলাকার মতো ভো শহরেও প্রাণঘাতী
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা শনাক্ত করা
হয় এই শহরেই, ২৩ ফেব্রুয়ারি। করোনাভাইরাসের জন্য এই শহরকেই সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক এলাকা’ (রেড জোন) হিসেবে মনে
করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৩ মার্চ থেকে সেখানে নতুন কোনো সংক্রমণের খবর পাওয়া
যায়নি। ইতালির অন্যান্য অঞ্চলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত ও সংক্রমণের
সংখ্যা হুঁ হুঁ করে বাড়ছে,
সেখানে ভো-এর অবস্থান একেবারে ভিন্ন। কীভাবে এই বিস্ময়কর
অগ্রগতি সম্ভব হলো, তার কারণ জানিয়েছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর শহরের সব বাসিন্দার করোনা
পরীক্ষা করেন তারা। সবাইকে পরীক্ষা করা হয়। আর তাতেই মেলে সুফল। ভেনেতোর আঞ্চলিক কর্মকর্তা
ও রেডক্রস কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে এই কাজটি করেন ভেনেতোর পাদুয়া শহরের ইউনিভার্সিটি
অব পাদুয়ার গবেষকরা। তারা জানান,
প্রথমে সবাইকে পরীক্ষা করা হয়। মোট বাসিন্দার ৩ শতাংশ
(৮৯ জন) মানুষের শরীরে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। কোনো লক্ষণ নেই, এমন মানুষের শরীরেও করোনা শনাক্ত করা হয়। এই বিষয়টি গবেষকদের
জন্য ছিল খুবই উদ্বেগের।
যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাড়িতেই কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা
করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়। অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে
মেলামেশার বিষয়ে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে অন্য কারও শরীরে সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে
পড়তে না পারে, সে জন্য তাদের হাসপাতালে পাঠানোর বিপক্ষে অবস্থান নেন গবেষকরা। দুই সপ্তাহ বাড়িতে
কোয়ারেন্টাইনের পর ভো শহরের বাসিন্দাদের আরেক দফা গণপরীক্ষা করেন গবেষকরা। তখন দেখা যায়, সংক্রমণের সংখ্যা ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে।
চিকিৎসায় মিলেছে সাফল্য
সিঙ্গাপুর
সাধারণভাবেই চিকিৎসার জন্য সারা বিশ্বে নামডাক
আছে সিঙ্গাপুরের। করোনাভাইরাস মহামারীর কবল থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারেনি তারাও। তবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত
রোগীর চিকিৎসায় দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর। কভিড-১৯ চিকিৎসায় এখন
পর্যন্ত এ রোগের সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক না থাকলেও দেশটিতে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে
অর্ধেকই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। ৪৫৫ জনের মধ্যে ১৪৪ জনই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। মৃত্যু হয়েছে মাত্র
দুজনের। আরও ৩০৯ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা স্থিতিশীল
বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া আইসিইউতে আছেন আরও ১৪ জন। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য
কর্মকর্তারা জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে দেশটিতে সন্দেহজনক প্রায় দেড় হাজারেরও
বেশি মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা আরও প্রায় ৩ হাজার জনকে চিহ্নিত
করা হয়েছে। এ ছাড়া কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ পূর্ণ করেছেন অন্তত দুই হাজার মানুষ। এসব করেই সিঙ্গাপুর
করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের সব মন্ত্রী এবং অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিরা
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অর্থ সহায়তা করার জন্য এক মাসের বেতন নেবেন না বলে শুক্রবার
জানিয়েছেন দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী কেং সুয়ে কিয়েট। সারা বিশ্বে এই ঘোষণা
প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সার্সের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
হংকং
চীনে উৎপত্তির পর মহামারী আকার ধারণ করা করোনাভাইরাস
ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- উহানের নিকটবর্তী চীনের আরেক স্বায়ত্তশাসিত
রাজ্য হংকং কিন্তু শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত রেখেছে। তারা বেশ ভালোভাবেই
মোকাবিলা করেছে মরণব্যাধি করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত হংকংয়ে মাত্র ৩৯৪ জন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত
হয়েছেন এবং এর প্রকোপে মারা গেছেন মাত্র চারজন। সেখানে করোনার প্রকোপ
প্রায় নিয়ন্ত্রণাধীন। ২৩ জানুয়ারি হংকংয়ে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়। ভাইরাস প্রাদুর্ভাব
নিয়ন্ত্রণে হংকংকে সবচেয়ে বেশি যেটা সাহায্য করেছে তা হলো তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা। ২০০৩ সালের সার্সের
সময় চীনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হংকং। হংকংয়ের সাধারণ মানুষ
ব্যক্তিগত সচেতনতা মেনে চলার দিক থেকে যথেষ্ট সচেতন। সেখানে প্রায় শতভাগ
মানুষের মুখে মাস্ক। সবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চলছে, কিন্তু তারা চেষ্টা করছে ভিড়, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে। ব্যক্তিগত সচেতনতা
পালনের চেষ্টা করছেন তারা,
সাধারণ জ্বর-সর্দি থাকলেও কর্মক্ষেত্রে আসছেন
না। সরকারিভাবেও যথেষ্ট সতর্কতা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও পদক্ষেপ
নিতে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি ভবনের প্রবেশপথে, সেটি রেস্টুরেন্ট, আবাসিক ভবন বা ব্যবসা
প্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন,
সেসব জায়গায় দেখা যায় নিরাপত্তারক্ষীরা সবার
শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করছেন,
মাস্ক না পরে কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। বিল্ডিংয়ের প্রত্যেকটি
গেটের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা রয়েছে। যারাই বিল্ডিংয়ে প্রবেশ
করবেন, তাদের সবারই হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ঢুকতে হবে। এ ছাড়াও সন্দেহভাজনদের
বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন,
পাবলিক লাইব্রেরি, পাবলিক জিমনেশিয়াম, স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে
গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে হংকং।
চাইলেই ঠেকিয়ে দেওয়া যায়!
তাইওয়ান
পুরো বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস মহামারীতে কাঁপছে
তখন এর বিরুদ্ধে দারুণ সফল তাইওয়ান। উৎপত্তিস্থল চীনের খুব কাছাকাছি হলেও সেখানে এখন পর্যন্ত মাত্র
২২১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন মাত্র দুজন। শুধু তাই নয়, সেখানে জীবনযাত্রা একেবারেই স্বাভাবিক। শুধু গণপরিবহনে চলাচলের
সময় লোকজনকে মাস্ক পরতে হচ্ছে। হংকংয়ের মতো তাইওয়ানও ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের
শিক্ষা কাজে লাগিয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে। প্রমাণ করেছে চাইলেই
এমন মহামারী ঠেকিয়ে দেওয়া যায়। ২০০৩ সালে দেশটিতে সার্স ভাইরাস মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এবারের চিত্র
সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যে ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তার ছিটেফোঁটাও তাইওয়ানে নেই। চীনের খুব কাছে থাকায়
২ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার দেশ তাইওয়ানকে ‘দ্বিতীয় সর্বোচ্চ
ঝুঁকিপূর্ণ’ অঞ্চল হিসেবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এখানকার সাড়ে ৮ লাখ
মানুষ চীনের মূল ভূখন্ডে কাজ করেন। একেবারে চীনা নববর্ষের সময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায়
বিশেষজ্ঞরা তাইওয়ান বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা উদ্যোগ
ভাইরাস মোকাবিলায় তাদের সাফল্য এনে দেয়। প্রাথমিক স্তরের ভ্রমণের বিধিনিষেধ, আগ্রাসী পরীক্ষা, করোনাভাইরাস রোগীর
সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং কঠোর কোয়ারেন্টাইন বা পৃথকীকরণ বিধিমালা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, জনস্বাস্থ্যের প্রতিক্রিয়ার
জন্য পরিষ্কার ব্যবস্থাপনার কাঠামো এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সক্রিয় যোগাযোগও সাহায্য
করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে যদিও চীন থেকে
শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে,
তবু স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তাইওয়ান মহামারী মোকাবিলায় পশ্চিমাসহ সব আক্রান্ত দেশের জন্য
আরও ভালো মডেল হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া
সারা বিশ্বের মতো দক্ষিণ কোরিয়ায়ও ভয়ঙ্করভাবে
ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। গত মাসে হঠাৎ করেই ব্যাপকহারে করোনার সংক্রমণ শুরু হয় দেশটিতে। দিনে ছয়-সাতশ মানুষও
আক্রান্ত হয়েছে সেখানে। কিন্তু কয়েকদিনের ব্যবধানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে তারা। শহর বা দেশ অবরুদ্ধ
করে নয়, এর বদলে কোরীয় কর্তৃপক্ষ ভাইরাস আক্রান্ত বা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের
বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম করেছে। এ ছাড়া জনগণকে যথাসম্ভব
ভিড় এড়িয়ে চলা, অনুষ্ঠান পরিহার, মাস্ক পরিধান এবং পরিচ্ছন্নতা
বজায় রাখতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিমান যোগাযোগ বন্ধ না করে সিউল যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দরে
বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছে। সেখানে যাত্রীদের শারীরিক তাপমাত্রা পরীক্ষা, খুঁটিনাটি ভ্রমণ তথ্য, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত
বিস্তারিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত আড়াই লাখ মানুষের শারীরিক
পরীক্ষা করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। দেশটিতে প্রতিদিন অন্তত
১৫ হাজার মানুষের করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের মেডিকেল টেস্ট সম্পূর্ণ ফ্রি করে দিয়েছে
দক্ষিণ কোরিয়া। চিকিৎসকরা রেফার্ড করলে সন্দেহভাজন রোগীরা বিনামূল্যেই টেস্ট
করাতে পারছেন। দেশটির শতাধিক হাসপাতাল-ক্লিনিকের পাশাপাশি করোনাভাইরাস টেস্টে
প্রায় অর্ধশত ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরিও কাজ করছে। নাগরিকদের সংগৃহীত
তথ্য ব্যবহার করে সহজেই ভাইরাস সংক্রমণের উৎস নির্ধারণ, আক্রান্ত বা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা
করছে দক্ষিণ কোরিয়া কর্তৃপক্ষ। এসব তথ্য ব্যবহার করেই করোনা সংক্রমণের হার আশ্চর্যজনকভাবে কমিয়ে
এনেছে দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে মৃত্যুহারও অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। ইতালিতে করোনা আক্রান্তদের
মৃত্যুহার যেখানে ৫ শতাংশ,
সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত্যুহার ০.৮ শতাংশ
মাত্র।
চিকিৎসা বিপ্লব
এবার জানা গেল, করোনা রোগীর চিকিৎসায় রীতিমতো বিপ্লবী সাফল্য পেয়েছে চীনের স্বশাসিত
অঞ্চল ম্যাকাও। সেখানে সর্বশেষ আক্রান্ত ব্যক্তিটি সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, শুক্রবার ম্যাকাওয়ের সর্বশেষ ব্যক্তিটি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে
বাড়ি ফিরে গেছেন। শুরু থেকেই ম্যাকাও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। সেজন্য চীনের সঙ্গে
স্থলপথে যুক্ত অঞ্চলটিতে সেভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেনি। এরপরও দেশটিতে কভিড-১৯
এ আক্রান্ত ১০ জন শনাক্ত হয়। এসব আক্রান্তের দ্রুত আইসোলেশনে নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন
ম্যাকাও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
ম্যাকাওতে এখন আর কোনো করোনাভাইরাস রোগী নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় করোনায়
এখানে কারও মৃত্যু হয়নি। আক্রান্তদের সারিয়ে তোলা হয়েছে। নতুন করে কেউ আক্রান্ত
হননি। কোনো গুরুতর বিষয়ও নেই। ম্যাকাওতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি
থেকে নতুন করে কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি।
অন্যরকম নিয়ন্ত্রণ
আক্রান্তের হার আর মৃত্যুহার দেখলেই বোঝা
যাবে অন্যরকমভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে রাশিয়া। প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়ায়
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কম কেন?
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে করোনাভাইরাসে
আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫০৯। মারা গেছেন একজন। রাশিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কি আসলেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে? রাশিয়ার স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুতিনের কৌশল কাজ করেছে। রাশিয়া ৩০ জানুয়ারির
মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলো এলাকা কোয়ারেন্টাইন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার
পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- পরীক্ষা,
পরীক্ষা এবং পরীক্ষাই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের
বড় উপায়। আর রাশিয়া এই পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে জানুয়ারির শেষ দিক থেকেই। রাশিয়ায় এখন ১ লাখ
৫৬ হাজার কিট আছে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য। তবে রাশিয়া যে ব্যবস্থা
নেওয়ার কথা বলছে, তা নিয়ে অবশ্য নানা সমালোচনাও আছে। রাশিয়া আদৌ ঠিক সংখ্যা
বলছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। রাশিয়ার অতীত রেকর্ডের কারণেই এই অবিশ্বাস। রাষ্ট্রীয় স্তরে লুকোছাপার
ঘটনা রাশিয়ায় নতুন নয়। এর আগে ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময় প্রকৃত মৃত মানুষের
সংখ্যা নিয়ে টালবাহানা করেছিল রাশিয়া। তবে মস্কোর চিকিৎসকরা এ ধরনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু সরকারি চিকিৎসকরাই
নন, খোদ ডব্লিউএইচওর প্রতিনিধি ভুজনোভিক বলেছেন, ‘লুকোছাপার কিছু ঘটেনি। আর এখন সংক্রমণের সংখ্যা
কম মানে এটা নয় যে আর বাড়বে না।’
প্রাণপণ লড়াই
ভিয়েতনাম
শুরুর দিকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভিয়েতনাম
অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেছে। চীন সীমান্তঘেঁষা দেশটি মার্চের শুরুর দিকে ঘোষণা করেছে, দেশে যারা কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা সবাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন।
তবে মার্চের পর থেকেই নতুন নতুন আক্রান্তের
খবর পাওয়া যায়। করোনাভাইরাসের ওয়ার্ল্ডওমিটার অনুযায়ী, ভিয়েতনামে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১২৯ জন। এর মধ্যে সম্পূর্ণ
সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৭ জন। আর বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০৪ জন। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা
আশঙ্কাজনক। তবে মার্চের শুরুর দিকে ভিয়েতনামের সাফল্যের সূত্র ধরে সে দেশের
নেতৃত্বস্থানীয় লোকজন বলছেন আক্রান্তরা দ্রুতই সুস্থ হয়ে ফিরবেন। আর আক্রান্তের হারও
অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক কম। তাদের দাবি,
কভিড-১৯ এর সঙ্গে যুদ্ধে প্রথম রাউন্ডের মতোই
সফলভাবে জয়ী হবেন তারা। ভিয়েতনাম আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, যুদ্ধে তারা সম্পূর্ণ জয়ী হতে পারেনি। গত ২৩ জানুয়ারি ভিয়েতনামে
প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। এরপর দেশটির পক্ষ থেকে করোনাকে মহামারী ঘোষণা করা হয়। এক পর্যায়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি
আরও কয়েকজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয় দেশটিতে। পরে গ্রাম অবরুদ্ধ
করে প্রাদুর্ভাব ঠেকায়।
0 Comments